পৃথিবী ছেড়ে যেতে এতো খেদ কেনো?

Avatar photo
Editorial Team
  • Update Time : Monday, January 28, 2019

সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী

গীতিকার বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী বহু বছর আগে একটা গান লিখে গেছেন। লোকে তাঁকে আদর করে ‘পাগল বিজয়’ নামেও ডাকে। ওনার লেখা একটা জনপ্রিয় গান – “এই পৃথিবী যেমনি আছে তেমনি ঠিক রবে”। বাংলাদেশে যারা লোকসঙ্গীত প্রেমী, তাদের সবাই এ গানটা চেনেন এবং শুনেছেনও। আমিও এটা শুনি মাঝে-মাঝেই। একারণে নয় যে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া নিয়ে আমার মনে কোনো খেদ বা ভয় আছে। বরং আমি গানটা শুনি ভিন্ন এক কারণে। আমার বুঝতে ইচ্ছে করে, “সুন্দর” এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে সবার মনে এতো কষ্ট এতো পরিতাপ কেনো। যারা আমাকে চেনেন, তাদের সবাই জানেন, আমি ধর্মহীন-ধার্মিক। আমার কাছে জীবনের সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন। সবাই যখন বলে মানুষ মরে, আমি বলি মানুষ তো জন্মায়ই না, তাহলে মৃত্যুর কথা আসে কী করে। সবাই যখন এই জীবন বা তাদের ভাষায় ‘পার্থিব জীবন’-টা নিয়ে হাপিত্যেশে ব্যস্ত, তখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই। দেখি, ফেলে আসা শতাব্দীগুলোর নানা রঙ – নানা অবয়ব। নিগুর কিছু কথা আছে – অখন্ডনীয় কিছু সত্য আছে, এই জীবন নিয়ে। মানুষ যদি নিজেকে বিশেষ কোনো ধর্মের ব্র্যাকেটে আটকে ফেলে, তখন সে আর এসব বুঝতে পারেনা। এসব ভাবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার মতো যারা বাউন্ডুলে বাউল, তারা জানে, জীবনের গোপন তত্বটা।

পৃথিবীতে মানুষ নতুন দেহের অবয়ব নিয়ে যখনই আসে, তখনই সে ভুলে যায় তার আসল পরিচয়। নিজের অজ্ঞাতেই প্রেমে পড়ে যায় এই মাটিপানির পৃথিবীর। দোষটা আসলে দেহটারই। মাটিপানির দেহ তো মাটির টানে ফানা হবেই। এটাই তো স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই তার স্বীয় স্বত্বা বিলীন হয়ে যায় মাটিপানির দেহের তীব্র তান্ডবে। এই দেহের সবচেয়ে বড় ক্ষুধার নাম – কাম। লোকে বলে কাম মন্দ। ওরা কাম আর পাপে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলে। আমি বলি কামই সব। কামবিহনে সবকিছুই অর্থহীন। দেহের গহিনে কামের চিতা না জ্বালাতে পারলে সাধন হয়না। সন্যাস ধরার মানে কাম পরিত্যাগ নয়। আর নারীদের ক্ষেত্রে তো কামের গুরুত্ব আরো ব্যাপক। আমার একটা গানে বলেছি, ‘নারী যদি সন্যাস ধরে, জগত আন্ধার হইয়া যায়’। কেনো বলেছি? কারণ, নর-নারীর মাঝখানে যখন কাম নামের তীব্র শক্তিটার উদ্ভব ঘটে তখনই কেবল উচ্চ আধ্যাতিকতার জন্ম হয়। একারণেই, নারী যদি হয়ে যায় কামবিহীন সন্যাসিনী তাহলে তো থেমে যাবে মহাজগতের সব লীলাখেলা। সৃষ্টি-ধ্বংসের পালাবদল।

সনাতনী ধর্মে পুনর্জন্মের কথা বলা আছে। একথাটা সব শাস্ত্রেই আছে। পূরাণেও আছে, কোরানেও আছে। কিন্তু মূর্খ মোল্লার দল এসব বুঝতেই চায় না। কিংবা বুঝতে পারেনা। কোরানের কোথাও আত্মার মৃত্যুর কথা নেই। আসলে মৃত্যুর কথাই নেই। আছে মাটিপানির দেহের প্রবৃত্তির সমাপ্তির কথা। আমি নিজে পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। আমি জানি, মাটিপানির এই পৃথিবীতে আসা-যাওয়ার এক সমাপ্তিহীন পালা চলছে সে-ই কবে থেকে। আমি ভাসছি সেই পালাবদলের ঢেউওয়ে। আসছি আবার চলে যাচ্ছি। ফের ফিরে আসছি। নতুন পরিচয়ে – নতুন আরেক সমাজ কিংবা লোকালয়ে।

মানুষ বলে, ‘রক্তের সম্পর্কের’ কথা, আমি বলি রক্তের সম্পর্ক আসলেই কিছু নয়। কারণ সেটা একেবারেই মাটিপানির দেহের মাঝেই আটকে থাকে। আত্মাই হলো সব। আর আত্মার তো রক্তের সম্পর্কের সুযোগ নেই! আধ্যাতিকতা হচ্ছে আত্মার বিষয়। সেখানে মাটিপানির দেহের গুরুত্বই নেই। আমি যদি অনাধ্যাতিক বা আধ্যাতিকতা বিবর্জিত হয়ে পড়ি, তাহলেই মাটিপানি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর আমি যখন আধ্যাতিক, তখন তো আমার কাছে শরীরটা নেহায়েত গৌণ একটা বিষয়।

জানি এবার সবাই প্রশ্ন করবেন, আমি কি তাহলে মাটিপানির দেহ বিবর্জিত সন্যাসের কথা বলছি। একদম না। আমি সন্যাসী নই। কারণ সন্যাস যাপনে পূণ্য নেই – পাপ আছে নিশ্চিত। সবকিছু ত্যাগ করে, পাহাড়-জঙ্গলে নির্বাসন নিতে আমরা পৃথিবীতে আসিনা। এখানে আমাদের আসার পেছনে প্রত্যেকবারই এক-একটা লক্ষ্য বা মিশন থাকে। কেউ-কেউ সেটা মনে রাখে। বাকীরা বেমালুম ভুলে যায়। ভুলে যাওয়ার পেছনে মুল কারণ হচ্ছে ‘পাপ’ ভীতি বা ‘পাপ’ আতংক। আমার চৌহদ্দিতে ওই ‘পাপ’ চিন্তার প্রবেশ নিষেধ। কারণ আমি এই পৃথিবীতে এসেছি একটা মিশন নিয়ে। সেটা সফলভাবে শেষ করে আবার পরবর্তী জীবনের দিকে পা বাড়ানোর স্বার্থেই পাপচিন্তা নামক বিভ্রান্তি দূর করে দিতে হবেই।

বর্তমান জীবনে যে সমাজে আমার বসবাস, এখানকার প্রায় সবাই ভাবে আমি নাস্তিক। কী করে বুঝাই ওদের আধ্যাতিকতা-বিবর্জিত আস্তিকতাই আসলে নাস্তিকতা। যার জীবনে আধ্যাতিকতার উপস্থিতি নেই, সে ধার্মিক হয় কীভাবে? একারণেই আমি ধর্মহীন-ধার্মিক। আমার অস্তিত্বের সর্বত্র আধ্যাতিকতার বসবাস। এটা যারা বুঝবেনা, ওদের কাছে আমি তো নাস্তিক হবোই।

অনেক দম্পতি আছেন যারা মিছেমিছি নিজেদের আত্মারসঙ্গী সম্বোধনের মেকি প্রতিযোগিতা করেন। বিনয়ের সাথেই বলছি, এটা এক ধরণের ভণ্ডামি। লোকদেখানো কিংবা লোক ঠকানোর চতুরতা। যারা এটা করেন, তারা আসলে ওই দাম্পত্যজীবন পূর্ববর্তী কিছু ভালো-না-লাগা স্মৃতি বা শারীরিক নষ্টামি ঠাসা অতীতের মন্দ কিছু ঘটনা ঢাকতেই এসব করেন। আর কিছুই নয়। কেউ যখন এই বিশেষ শব্দটা আওড়ায়, আমি তাৎক্ষনিক বুঝে নিই যা বোঝার। হয়তো একারণেই আমার কাছাকাছি যাদের আসার সুযোগ হয়, ওরা এধরনের শব্দচয়ন সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলে।

দাম্পত্য সম্পর্ক আত্মায়-আত্মায় হয়না। সেখানে সবকিছুই ওই মাটিপানির দেহকেন্দ্রিক। আত্মারসঙ্গী হওয়া কি মুখের কথা? আত্মারসঙ্গী হতে গেলে আধ্যাতিকতা লাগে। কেবল কামবাসনার ছোঁয়ায় ওসব জাগেনা। আবার শুধুমাত্র আধ্যাতিকতা থাকলেও চলবেনা। আধ্যাতিকতার সাথে তীব্র কামনার সংমিশ্রণ হতে হয়। এটা অসম্ভব নয়, তবে ভীষণ জটিল। জ্বলন্ত অনলের চারপাশে সাতপাক ঘুরলে কিংবা মোল্লা-পূরোহিতের কিছু শ্লোক শুনলে মানুষ হয়তো সমাজের বিচারে দম্পতি হয় বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে ওদের  মাঝে প্রকৃত বন্ধন হয়না একদম।

পৃথিবীতে আসাটা যেমন কোনো কষ্টের বা অনূশোচনার বিষয় নয়, ঠিক তেমনিভাবে এখান থেকে অন্য আরেক নতুন জীবনের পথে পা বাড়ানোও ধারাবাহিক এক পালাবদলের প্রক্রিয়া। আর কিছুই নয়। পৃথিবীতে প্রতিবার – প্রতিটি জন্মে কিছু একটা করে যেতেই হয় – মিশন সফল করতে হলে। তা না হলে তো পরবর্তী পালাক্রমগুলো আরো বেশী জটিল হয়েও যেতে পারে। আরেকটা কথা বলে লেখাটা শেষ করবো – যদি কখনো আধ্যাতিকতার গহীন জলে ডুবে থাকা কোনো কারো সন্ধান পান, তার সামনে পার্থিব জীবনের ভুলভাল তত্বগুলো মেলে ধরে অযথাই নিচেকে বিকর্ষীত করবেন না। এটা করলে বড় বেশী ভুল করবেন। জেনে রাখবেন, আধ্যাতিকতা জগতের বাসিন্দাদের ভাবনা-চিন্তা একেবারেই আলাদা। ওরা আপনাকে যেমন এক ঝটকায় বুকে তুলে নিবে, আবার সামান্য ভুলের কারণেই পর করেও দেবে চোখের পলকে।

এই লেখাটা যে কারণে লিখেছি, সেই বিজয় কৃষ্ণ অধিকারীর গানটির কথা এবং একটা ভিডিও এই লেখাটার সাথে জুড়ে দিলাম। আশাকরি শুনবেন এবং আপনার অভিব্যাক্তি বা ভাবনা আমায় জানাবেন।

এই পৃথিবী যেমনি আছে তেমনই ঠিক রবে
সুন্দরও এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে
সেই নগত তলব তাগিত পত্র নেমে আসবে যবে
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে ।।

হোক না কেন যত বড় রাজা-জমিদার
পাকা-বাড়ি ঝুঁড়ি-গাড়ি ঘড়ি-ট্রেনজিষ্টার
তখন থাকবেনা আর কোন অধিকার বিষয়ও-বৈভবে ।।

চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা আকাশ-বাতাস জল
যেমন আছে তেমনি সবই রইবে অবিকল
মাত্র আমি আর রইবনা জনপূর্ণ ভবে ।।

শব্দ-স্পর্শ রূপ-রস গন্ধ বন্ধ হলে যেন
এই পৃথিবীর অস্তিত্ববোধ রইবেনা আর হেন
পাগল বিজয় বলে সেই দিন যেন এসে পরবে কবে ।।

সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জঙ্গিবাদ বিরোধী সাংবাদিক, কলামিষ্ট, গীতিকার-সুরকার, চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, জমজমাট-এর প্রধান সম্পাদক এবং ব্লিটজ সম্পাদক। যোগাযোগঃ ইমেইল, ফেইসবুক এবং টুইটার

গানের ভিডিওটা দেখতে হলে নিচের লিংক ক্লিক করুন

 

 

 

Avatar photo Blitz’s Editorial Board is responsible for the stories published under this byline. This includes editorials, news stories, letters to the editor, and multimedia features on BLiTZ

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  
© All rights reserved © 2005-2024 BLiTZ
Design and Development winsarsoft