একজন নাইজেল আক্কারা এবং তাঁর আরেক ইনিংস

Avatar photo
Editorial Team
  • Update Time : Saturday, January 26, 2019

সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী

ব্যাখ্যাঃ

নাইজেল আক্কারা’র ‘কোলাহল’ গ্রুপের নাটকটির নামের বানান কলকাতার কাগজগুলো ভুল করে লিখছে ‘ঝড়াফুলের রূপকথা’। আমরা ইচ্ছে করেই সেটা যদিও লিখেছি কিন্তু সঠিক বানানটা হবে – ‘ঝরাফুলের রূপকথা’। আমাদের প্রত্যাশা পশ্চিম বঙ্গের সাংবাদিক বন্ধুরা অন্ততপক্ষে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নশীল হবেন।

নাইজেল আক্কারা নামটা আবারও লোকের মুখে-মুখে ফিরছে। ঠিক যেমনটা ছিলো বেশ কিছু বছর আগে। সংশোধনাগারে থাকার সময় তিনি আলোকনন্দা রায়ের হাত ধরে বাল্মিকি প্রতিভা’য় সবার নজর কেড়েছিলেন। তারপর কলকাতার অভিনেত্রী ঋতুপর্ণার সাথে প্রথম সেলুলয়েড দুনিয়ায় পা রাখেন ‘মুক্তধারা’ ছবির মাধ্যমে। আমি ওই ছবিটা দেখেছি। নাইজেল আক্কারা ন’বছর কারাগারে কাটিয়েছেন ভারতে। আর আমি ঠিক একই দৈর্ঘের সময় কাটিয়েছি বাংলাদেশের কারাগারে। সমাজের দৃষ্টিতে আমরা দু’জনই হয়তো মন্দ মানুষ কিংবা দাগী আসামী। যদিও এতে আমার বা নাইজেলের কিছুই যায়-আসেনা। কারণ আমরা জানি, পরিস্থিতির শিকার হয়ে কারাগারে গেলেই মানুষ পচে যায়না – দুর্গন্ধ ছড়ায় না। বরং আমরাই পারি সমাজে সুঘ্রাণ ছড়াতে – সমাজটা বদলে দিতে। নাইজেলের ‘মুক্তধারা’ দেখে আমার ভালোলাগেনি। একদমই লাগেনি। কারণ, অতি-বাণিজ্যিক চিন্তার মানুষগুলো ওই ছবিটায় কারাগার কিংবা ওই ভিন্ন আরেক জগতের মানুষগুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেখানে কেবল জেলখানার বন্দীদের মন্দ মানুষ হিসেবে দেখানোরই অশুভ প্রতিযোগিতা হয়েছে। বানোয়াট গল্প ফেঁদে দর্শকদের বোকা বানানো হয়েছে। আমার এধরণের চাঁছাছোলা কথায় যদি কেউ কষ্ট পান, আমার সত্যিই কিছু করার নেই। কারণ, যারা জেল খেটেছেন, ওদের মনের অবস্থা অন্যরা বুঝতেই পারেননা। ওরা আমাদের দেখেন ওদের মতো করে – আমাদের মতো করে নয়।

যাক, মুক্তধারা ছবিটা নিয়ে এর বেশী কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়না। কিন্তু নাইজেল আক্কারাকে নিয়ে অনেক কথাই বলার আছে – বলবোও ক্রমান্বয়ে। এই একটা লেখাতেই নয় – অনেক লেখায় – হাজার লেখায়।

ব্লিটজ-য়ের জন্যে এই লেখাটা ইংরেজীতেই হওয়া সমীচীন ছিলো। কিন্তু সেটা করা যাবেনা। কারণ এই লেখাটা যাদের নিয়ে, ওঁদের অনেকেই হয়তো ইংরেজি জানেননা। তাই ইংরেজিতে লেখাটা ছাপা হলে ওঁরা কষ্ট পাবেন। একারণেই বাংলায় লিখছি। বহু বছর হলো বাংলা পত্র-পত্রিকায় লেখার সময় পাইনা। আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা একটা কাগজ বেরুচ্ছে। নাম – জমজমাট। তখন যে নাইজেলকে নিয়ে অনেক লেখাই ছাপা হবে এতেতো সামান্য সন্দেহও নেই। কিন্তু আপাতত ব্লিটজ-য়েই লিখছি। অনেকদিন বাংলায় লেখালেখিঢ় চর্চা না থাকায় ভুলভ্রান্তির অন্ত হতো থাকবেন। তাই, আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আলোকানন্দা রায়ের কারণেই নাইজেল আক্কারার জীবনে নতুন আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, এমনটা সবাই বললেও আমি বলবোনা। কারণ আমি জানি, যারা কারাগারে জীবনের এতো দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়ে ফেলেন, ওঁরা আসলে নিজেরাই নিজেদের বদলে দেয়ার কারিগর হয়ে যান। তবু, নাইজেল আক্কারাকে ওই জীবন থেকে আজকের জীবনে আসার অনুপ্রেরণা দেয়ায় আলোকানন্দা রায়কে সশ্রদ্ধ নমস্কার।

সমাজের অবহেলিতদের পাশে এবার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন নাইজেল আক্কারা। আর একাজের জন্য যাদের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন, ওঁরা সবাই উত্তর কলকাতার প্রমোদালয় সোনাগাছির প্রমোদকর্মী, যাদের সমাজ যৌনকর্মী হিসেবে চেনে। এই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটার বিষয়ে আমার চরম আপত্তি। এধরণের শব্দ চয়ন একেবারেই উচিৎ নয়। এটা আসলে এই পচে যাওয়া সমাজের নষ্ট মানষিকতারই বহিঃপ্রকাশ। আমি ওঁদেরকে প্রমোদকর্মী নামেই ডাকবো।

নাইজেল আক্কারা তাঁর নাটক ‘ঝড়াফুলের রুপকথা’ (ঝরাফুলের রূপকথা)র মাধ্যমে ওই প্রমোদকর্মীদের এবার একেবারে মঞ্চে নিয়ে এলেন। সাবাস নাইজেল! নাটকটি হচ্ছে কোলাহল থিয়েটারের ব্যানারে। কোলাহল তাদের প্রথম নাটক উপস্থাপনা করে ৪ঠা জুন ২০১৪ সালে। এবার কোলাহল ও প্রমোদকর্মীদের নিয়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘ঝরাফুলের রূপকথা’।

‘ঝড়াফুলের রূপকথা’ কেবলমাত্র একজন প্রমোদকর্মীর জীবনের গল্প নয়, বরং এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবীর নন্দিনী, নটির পূজার শ্রীমতী, তাশের দেশের রুইতন ও হরতন একত্র চরিত্রের প্রতিফলন। নাটকটির মূল চরিত্র দুই প্রমোদকর্মী – আদর এবং গোগোল। ওঁরাই বলছেন প্রমদালোয়ের বিভিন্ন চরিত্রের ‘রূপকথা’।

কাহিনী ও নির্দেশনায় চিরঞ্জীব গুহ, সুরকার প্রজ্ঞ দত্ত ও ভাবনা এবং প্রযোজনায় নাইজেল আক্কারা। নাটকে গান গেয়েছেন প্রথমা দে, অরূনাশিষ রায়, ও অমিতাভ আচার্য্য আর নাচের নির্দেশনায় শিবায়ন গাঙ্গুলি। এই উদ্যোগে সাহায্য করেছে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি।

গত ২০শে জানুয়ারি কলকাতার মহাজাতি সদনে এর সূচনা মঞ্চায়ন হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি এনিয়ে সবার মাঝেই ভীষণ আগ্রহ। অনেকেই জানতে চাইছেন, পরবর্তী শো কোথায় ইত্যাদি। আমিও জানতে চেয়েছি, এই নাটক বাংলাদেশে কবে মঞ্চস্থ হবে। নাইজেল আক্কারা কথা দিয়েছেন, অদুর ভবিষ্যতেই ওঁরা আসবেন ঢাকার মঞ্চে। আমাদের এখানে তো আন্তর্জাতিকমানের অনেকগুলো মঞ্চ। জানিনা কলকাতার মঞ্চগুলো আরো আধুনিক কি-না। কলকাতার মঞ্চগুলো আমাদেরগুলোর চেয়ে আধুনিক হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের মতো ব্যাপক উন্নয়নশীল অর্থনীতির জোয়ার এখনো ভারতে শুরু হয়নি। তাছাড়া আমাদের এখানে সংস্কৃতি-মনষ্ক বিত্তবানের সংখ্যা অনেক। এসব কারনেই আমার বিশ্বাস, ‘ঝরাফুলের রূপকথা’ বাংলাদেশে এলে দর্শকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাবে।

বিশ্বের অন্য কোথাও প্রমোদকর্মীদের জীবনের গল্প এবং ওঁদের অভিনয়ে ‘ঝরাফুলের রূপকথা’র মতো কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। এমনও হতে পারে, বিশ্বে এটাই প্রথম। তবে দক্ষিন এশিয়ায় যে এধরণের নাটক এটাই প্রথম, সেটা আমি নিশ্চিত।

অনেকের মতো করে আমিও বলছি, এমন একটা মহতী উদ্যোগ সমাজে নতুন এক দিগন্ত খুলে দেবে। আগামিতে এঁদের অংশগ্রহনে চলচ্চিত্রও হবে – আমি নিশ্চিত। কিন্তু এর চেয়েও বড় কিছু বিষয় আছে। আমি চাইনা, ‘ঝরাফুলের রূপকথা’র পরিবার আবারও ফিরে যাক অন্ধকারে। সারা ভারতেই এধরনের নাটক একটা দু’টো নয় – অসংখ্য হওয়া চাই। এক্ষেত্রে সমাজের সবার, বিশেষ করে যারা বিনোদন জগতের সাথে জড়িত, তাদের এগিয়ে আসতেই হবে। কারণ, ‘ঝরাফুলের রূপকথা’ আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করে দিলো, অন্ধকার ওই জগতে কতোশতো প্রতিভা লুকিয়ে আছেন। ওঁদের তুলে ধরার দায়িত্বতো শুধু নাইজেল আক্কারারই নয়। সে দায়িত্ব আমাদের সবার।

সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ব্লিটজ-এর সম্পাদক

Avatar photo Blitz’s Editorial Board is responsible for the stories published under this byline. This includes editorials, news stories, letters to the editor, and multimedia features on BLiTZ

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2005-2024 BLiTZ
Design and Development winsarsoft